১০:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ৮ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘ঘুরে দাঁড়াবে গাজা’, শান্তিচুক্তিতে উপত্যকায় উচ্ছ্বাস, আছে ভয়ও

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৪:৫৬:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫
  • ১৮ Time View

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
দীর্ঘ দুই বছরের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পর অবশেষে এক আশাব্যঞ্জক খবর নিয়ে ঘুম ভাঙলো গাজার মানুষদের। হামাস ও ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় প্রথম ধাপের শান্তিচুক্তিতে উপনীত হয়েছে। এই চুক্তি যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে তা অবরুদ্ধ উপত্যকায় চলমান হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটাতে পারে।
নুসেইরাত শিবিরে আশ্রিত এক তরুণী ফিলিস্তিনি রোবা প্রথমে খবরটি বিশ্বাসই করতে পারেননি। তিনি বলেন, এমন অনেকবার হয়েছে। চুক্তি হয়েছে, তারপর আবার বোমা পড়েছে। তাই এখনই উদযাপন করতে ভয় পাচ্ছি।
রোবার নিজের ঘর ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজাজুড়ে ৯০ শতাংশের বেশি বাসস্থানই এখন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তিনি বলেন, বাড়িঘর নেই, স্কুল নেই, হাসপাতাল নেই, কিছুই নেই। ভবিষ্যতও অন্ধকার।
চুক্তির অংশ হিসেবে বন্দি বিনিময় ও ধীরে ধীরে ইসরায়েলি বাহিনীর প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একে ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির প্রথম ধাপ’ হিসেবে বলছেন। শারম আল শেখে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তুরস্ক, মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই ঘোষণা দেওয়া হয়।
তবে গাজার জনগণের মনে এখনও দ্বিধা, শান্তির আশার পাশাপাশি রয়েছে ক্লান্তি ও ভয়।
গাজার স্থপতি মোহাম্মদ সুহাইল এই চুক্তিকে বলছেন বেঁচে থাকার একটুখানি স্বস্তি। দুই বছরে ২ লাখ মানুষের মৃত্যু দেখেছি। এখন মনে হচ্ছে হয়তো ঘরগুলো আবার তুলতে পারব, জীবনটা আবার শুরু করতে পারব।
তিনি বলেন, বাস্তব পরিবর্তন আনতে হলে আরব দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন জরুরি। যদি প্রকৃত সহায়তা আসে, গাজা খুব দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
জাতিসংঘ ইতোমধ্যে ৭০০ কোটি ডলারের পুনর্গঠন তহবিলের আহ্বান জানিয়েছে। এতে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও মৌলিক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করা যাবে।
১৯ বছর বয়সী ইব্রাহিম দুই বছর আগে উচ্চমাধ্যমিকে ৯৭ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি স্থগিত হয়। এখন তিনি বলেন, গণহত্যা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দেয়নি, কিন্তু আমার মনোবল ভাঙতে পারেনি।
তিনি বিদ্যুৎ প্রকৌশল নিয়ে পড়তে চান, বিদেশে স্কলারশিপের আশায় ইংরেজি শিখছেন। তার আহ্বান, আমাদের প্রজন্মকে আবার শিক্ষার সুযোগ দিন। আমরা হারাইনি, শুধু থেমে গেছি।
ইউনিসেফের হিসাবে, গত দুই বছরে গাজায় ৬৪ হাজার শিশু নিহত বা আহত হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, ‘এক প্রজন্ম সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে।’
মধ্য গাজার মানবিক সহায়তা কর্মী আয়াদ আমাউই বলেন, এমন এক অনুভূতি বিশ্বাসও করছি, আবার ভয়ও পাচ্ছি। তিনি আশা করছেন, এবার চুক্তিটি বাস্তবায়িত হবে। গাজার মানুষের চোখ এখন বিশ্বের দিকে—দেখব, কে আমাদের পাশে দাঁড়ায়।
তার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ, ইসরায়েল যেন চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা না দেয়। আমরা শুধু ঘরবাড়ি নয়, মনোবলও পুনর্গঠন করতে চাই।
আমাউই জানান, চুক্তির খবর রাতে গাজায় পৌঁছেছিল। অনেকে ঘুমিয়ে ছিল, সকালে শুনে আনন্দাশ্রু ঝরেছে। আবার ভয়ও আছে, এই আনন্দ যেন ক্ষণিকের না হয়।
দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসি এলাকায় রাতভর চলেছে অপেক্ষা ও প্রার্থনা। এএফপি জানিয়েছে, ঘোষণার আগেই অনেকেই ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন। ৫০ বছর বয়সী মোহাম্মদ জামলট বলেন, প্রতিটি খবর আমরা টানটান উত্তেজনায় অনুসরণ করছি। আশা করি এবার শান্তি টিকবে।
তবে মানবিক পরিস্থিতি এখনও ভয়াবহ। অধিকাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত, খাদ্য সংকট, ও চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, টেকসই শান্তির সঙ্গে পুনর্গঠনের বাস্তব কর্মপরিকল্পনাও অপরিহার্য।
গাজার রোবা, মোহাম্মদ, ইব্রাহিম, আয়াদ কিংবা জামলট—সবার মনেই একই অনুভূতি: হয়তো এবার সত্যিই শান্তি আসবে। তবে সেই আশার সঙ্গে মিশে আছে ভয়, পৃথিবী তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে কি না

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে নিরাপদ সড়ক দিবসের আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত

‘ঘুরে দাঁড়াবে গাজা’, শান্তিচুক্তিতে উপত্যকায় উচ্ছ্বাস, আছে ভয়ও

Update Time : ০৪:৫৬:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
দীর্ঘ দুই বছরের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পর অবশেষে এক আশাব্যঞ্জক খবর নিয়ে ঘুম ভাঙলো গাজার মানুষদের। হামাস ও ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় প্রথম ধাপের শান্তিচুক্তিতে উপনীত হয়েছে। এই চুক্তি যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে তা অবরুদ্ধ উপত্যকায় চলমান হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটাতে পারে।
নুসেইরাত শিবিরে আশ্রিত এক তরুণী ফিলিস্তিনি রোবা প্রথমে খবরটি বিশ্বাসই করতে পারেননি। তিনি বলেন, এমন অনেকবার হয়েছে। চুক্তি হয়েছে, তারপর আবার বোমা পড়েছে। তাই এখনই উদযাপন করতে ভয় পাচ্ছি।
রোবার নিজের ঘর ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজাজুড়ে ৯০ শতাংশের বেশি বাসস্থানই এখন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তিনি বলেন, বাড়িঘর নেই, স্কুল নেই, হাসপাতাল নেই, কিছুই নেই। ভবিষ্যতও অন্ধকার।
চুক্তির অংশ হিসেবে বন্দি বিনিময় ও ধীরে ধীরে ইসরায়েলি বাহিনীর প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একে ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির প্রথম ধাপ’ হিসেবে বলছেন। শারম আল শেখে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তুরস্ক, মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই ঘোষণা দেওয়া হয়।
তবে গাজার জনগণের মনে এখনও দ্বিধা, শান্তির আশার পাশাপাশি রয়েছে ক্লান্তি ও ভয়।
গাজার স্থপতি মোহাম্মদ সুহাইল এই চুক্তিকে বলছেন বেঁচে থাকার একটুখানি স্বস্তি। দুই বছরে ২ লাখ মানুষের মৃত্যু দেখেছি। এখন মনে হচ্ছে হয়তো ঘরগুলো আবার তুলতে পারব, জীবনটা আবার শুরু করতে পারব।
তিনি বলেন, বাস্তব পরিবর্তন আনতে হলে আরব দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন জরুরি। যদি প্রকৃত সহায়তা আসে, গাজা খুব দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
জাতিসংঘ ইতোমধ্যে ৭০০ কোটি ডলারের পুনর্গঠন তহবিলের আহ্বান জানিয়েছে। এতে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও মৌলিক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করা যাবে।
১৯ বছর বয়সী ইব্রাহিম দুই বছর আগে উচ্চমাধ্যমিকে ৯৭ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি স্থগিত হয়। এখন তিনি বলেন, গণহত্যা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দেয়নি, কিন্তু আমার মনোবল ভাঙতে পারেনি।
তিনি বিদ্যুৎ প্রকৌশল নিয়ে পড়তে চান, বিদেশে স্কলারশিপের আশায় ইংরেজি শিখছেন। তার আহ্বান, আমাদের প্রজন্মকে আবার শিক্ষার সুযোগ দিন। আমরা হারাইনি, শুধু থেমে গেছি।
ইউনিসেফের হিসাবে, গত দুই বছরে গাজায় ৬৪ হাজার শিশু নিহত বা আহত হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, ‘এক প্রজন্ম সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে।’
মধ্য গাজার মানবিক সহায়তা কর্মী আয়াদ আমাউই বলেন, এমন এক অনুভূতি বিশ্বাসও করছি, আবার ভয়ও পাচ্ছি। তিনি আশা করছেন, এবার চুক্তিটি বাস্তবায়িত হবে। গাজার মানুষের চোখ এখন বিশ্বের দিকে—দেখব, কে আমাদের পাশে দাঁড়ায়।
তার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ, ইসরায়েল যেন চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা না দেয়। আমরা শুধু ঘরবাড়ি নয়, মনোবলও পুনর্গঠন করতে চাই।
আমাউই জানান, চুক্তির খবর রাতে গাজায় পৌঁছেছিল। অনেকে ঘুমিয়ে ছিল, সকালে শুনে আনন্দাশ্রু ঝরেছে। আবার ভয়ও আছে, এই আনন্দ যেন ক্ষণিকের না হয়।
দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসি এলাকায় রাতভর চলেছে অপেক্ষা ও প্রার্থনা। এএফপি জানিয়েছে, ঘোষণার আগেই অনেকেই ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন। ৫০ বছর বয়সী মোহাম্মদ জামলট বলেন, প্রতিটি খবর আমরা টানটান উত্তেজনায় অনুসরণ করছি। আশা করি এবার শান্তি টিকবে।
তবে মানবিক পরিস্থিতি এখনও ভয়াবহ। অধিকাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত, খাদ্য সংকট, ও চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, টেকসই শান্তির সঙ্গে পুনর্গঠনের বাস্তব কর্মপরিকল্পনাও অপরিহার্য।
গাজার রোবা, মোহাম্মদ, ইব্রাহিম, আয়াদ কিংবা জামলট—সবার মনেই একই অনুভূতি: হয়তো এবার সত্যিই শান্তি আসবে। তবে সেই আশার সঙ্গে মিশে আছে ভয়, পৃথিবী তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে কি না