১০:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ৮ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ধুলোয় মিশে গেছে গাজার অধিকাংশ মসজিদ, ধ্বংসস্তূপে চলছে আজান ও নামাজ

  • Reporter Name
  • Update Time : ১২:২৯:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫
  • ৪০ Time View

সবুজদিন রিপোর্ট।।
ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা যুদ্ধের সময় গাজা উপত্যকার অধিকাংশ অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল। আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায়নি মসজিদগুলোও। যেসব মিনার একসময় মানুষকে নামাজের জন্য ডাকত, সেগুলোও অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রাচীন মসজিদগুলো পাথর ও ধুলোর স্তূপে পরিণত হয়েছে।
দুই বছরের যুদ্ধের ফলে এই উপত্যকা প্রায় মিনারবিহীন হয়ে পড়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্থাপিত স্থাপত্যগুলোর কোনো চিহ্ন নেই – যেন ইতিহাস নিজেই বোমা হামলার শিকার হয়েছে।
গাজা শহরের শুজাইয়্যা পাড়ার উপকণ্ঠে ৬২ বছর বয়সী আবু খালেদ আল-নাজ্জার ইবনে ওসমান মসজিদের ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে তিনি শৈশব থেকেই নামাজ পড়ছেন।
তিনি দুঃখ এবং অবিশ্বাসে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাবার কণ্ঠস্বর বোঝার আগে আমি মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর চিনতাম। আমি পঞ্চাশ বছর ধরে এখানে নামাজ পড়েছি… আর আজ দরজার পাশে থাকা নামাজের গালিচাটিও ধ্বংসস্তূপের নিচে উধাও হয়ে গেছে। আমি কখনো কল্পনাও করিনি, এমন দিন আসবে, যখন আমরা মসজিদ ছাড়া নামাজ পড়ব।’
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস নিশ্চিত করেছে, দুই বছরে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী উপত্যকাজুড়ে মোট ১ হাজার ২৪৪টি মসজিদের মধ্যে ৮৩৫টিরও বেশি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছে এবং ১৮০টি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর মধ্যে মামলুক এবং অটোমান মসজিদও রয়েছে – এর মধ্যে কয়েকটি সাত শতাব্দীরও বেশি পুরনো।
পুরাতন শহরে গ্রেট ওমারি মসজিদের স্থানে ২৭ বছর বয়সী মাহমুদ কান্দিল ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিবলা দেয়াল থেকে খোদাই করা একটি পাথরের সন্ধান করছেন।
তিনি বলছিলেন, ‘এই মসজিদটি ছিল গাজার প্রাণকেন্দ্র। আমি এখানেই আমার প্রথম শুক্রবারের নামাজ পড়েছিলাম। মামলুক যুগের মার্বেল স্তম্ভগুলো এখানে ছিল। এখন ধুলো ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মনে হচ্ছে তারা (ইসরায়েলি বাহিনী) কেবল এর ভবনগুলো নয়, শহরের স্মৃতিও মুছে ফেলতে চায়।’
আল-দারাজ পাড়ায় একসময় আল-সাইয়্যিদ হাশিম মসজিদ ছিল। স্থানটির কয়েক মিটার দূরে ৭৪ বছর বয়সী উম্মে ওয়ায়েল ধসে পড়া সবুজ গম্বুজের ধ্বংসাবশেষের সামনে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন।
তিনি হাত তুলে বলেন, ‘আমি অসুস্থ থাকাকালীনও প্রতি বৃহস্পতিবার মসজিদে সূরা আল-কাহফ পড়তে যেতাম। এখন আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তবে আমরা আমাদের ঘর থেকে কুরআন পড়তে থাকব, আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আল্লাহ আমাদের কথা শোনেন।’
খান ইউনিসে ৪৫ বছর বয়সী আবদুর রহমান আল-সাত্রি ধ্বংস হয়ে যাওয়া মসজিদ সম্পর্কে বলেন, ‘মসজিদটি আমাদের একত্রিত করেছিল, কেবল নামাজের জন্য নয়। এটি ছিল এলাকার কেন্দ্রস্থল; এতে একটি লাইব্রেরি ছিল, কুরআন পাঠ ছিল, বিবাহ, জানাজা সবই ছিল…। তারা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে, যেন তারা চায় আমরা আত্মা ছাড়া বাঁচি।’
ইসলামিক ইতিহাস গবেষক মোহাম্মদ জুহা বলেন, গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের ধর্মীয় স্মৃতি এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর ইচ্ছাকৃত আক্রমণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘মিনারগুলো ছিল শহরের ল্যান্ডমার্ক, আর এখন মানুষের স্মৃতিতে কেবল এগুলোর নাম রয়ে গেছে।’
এত কিছুর পরেও গাজা থেকে আজানের শব্দ কখনো মুছে যায়নি। বিধ্বস্ত এলাকায় যুবকরা ছাদের ধ্বংসাবশেষে উঠে ছোট ব্যাটারিচালিত লাউডস্পিকারের মাধ্যমে আজান দিচ্ছে। সন্ধ্যায় লোকেরা ভাঙা দেয়ালের কোণে পুরানো মাদুর বিছিয়ে প্রার্থনা করছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে নিরাপদ সড়ক দিবসের আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত

ধুলোয় মিশে গেছে গাজার অধিকাংশ মসজিদ, ধ্বংসস্তূপে চলছে আজান ও নামাজ

Update Time : ১২:২৯:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫

সবুজদিন রিপোর্ট।।
ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা যুদ্ধের সময় গাজা উপত্যকার অধিকাংশ অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল। আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায়নি মসজিদগুলোও। যেসব মিনার একসময় মানুষকে নামাজের জন্য ডাকত, সেগুলোও অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রাচীন মসজিদগুলো পাথর ও ধুলোর স্তূপে পরিণত হয়েছে।
দুই বছরের যুদ্ধের ফলে এই উপত্যকা প্রায় মিনারবিহীন হয়ে পড়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্থাপিত স্থাপত্যগুলোর কোনো চিহ্ন নেই – যেন ইতিহাস নিজেই বোমা হামলার শিকার হয়েছে।
গাজা শহরের শুজাইয়্যা পাড়ার উপকণ্ঠে ৬২ বছর বয়সী আবু খালেদ আল-নাজ্জার ইবনে ওসমান মসজিদের ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে তিনি শৈশব থেকেই নামাজ পড়ছেন।
তিনি দুঃখ এবং অবিশ্বাসে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাবার কণ্ঠস্বর বোঝার আগে আমি মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর চিনতাম। আমি পঞ্চাশ বছর ধরে এখানে নামাজ পড়েছি… আর আজ দরজার পাশে থাকা নামাজের গালিচাটিও ধ্বংসস্তূপের নিচে উধাও হয়ে গেছে। আমি কখনো কল্পনাও করিনি, এমন দিন আসবে, যখন আমরা মসজিদ ছাড়া নামাজ পড়ব।’
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস নিশ্চিত করেছে, দুই বছরে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী উপত্যকাজুড়ে মোট ১ হাজার ২৪৪টি মসজিদের মধ্যে ৮৩৫টিরও বেশি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছে এবং ১৮০টি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর মধ্যে মামলুক এবং অটোমান মসজিদও রয়েছে – এর মধ্যে কয়েকটি সাত শতাব্দীরও বেশি পুরনো।
পুরাতন শহরে গ্রেট ওমারি মসজিদের স্থানে ২৭ বছর বয়সী মাহমুদ কান্দিল ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিবলা দেয়াল থেকে খোদাই করা একটি পাথরের সন্ধান করছেন।
তিনি বলছিলেন, ‘এই মসজিদটি ছিল গাজার প্রাণকেন্দ্র। আমি এখানেই আমার প্রথম শুক্রবারের নামাজ পড়েছিলাম। মামলুক যুগের মার্বেল স্তম্ভগুলো এখানে ছিল। এখন ধুলো ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মনে হচ্ছে তারা (ইসরায়েলি বাহিনী) কেবল এর ভবনগুলো নয়, শহরের স্মৃতিও মুছে ফেলতে চায়।’
আল-দারাজ পাড়ায় একসময় আল-সাইয়্যিদ হাশিম মসজিদ ছিল। স্থানটির কয়েক মিটার দূরে ৭৪ বছর বয়সী উম্মে ওয়ায়েল ধসে পড়া সবুজ গম্বুজের ধ্বংসাবশেষের সামনে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন।
তিনি হাত তুলে বলেন, ‘আমি অসুস্থ থাকাকালীনও প্রতি বৃহস্পতিবার মসজিদে সূরা আল-কাহফ পড়তে যেতাম। এখন আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তবে আমরা আমাদের ঘর থেকে কুরআন পড়তে থাকব, আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আল্লাহ আমাদের কথা শোনেন।’
খান ইউনিসে ৪৫ বছর বয়সী আবদুর রহমান আল-সাত্রি ধ্বংস হয়ে যাওয়া মসজিদ সম্পর্কে বলেন, ‘মসজিদটি আমাদের একত্রিত করেছিল, কেবল নামাজের জন্য নয়। এটি ছিল এলাকার কেন্দ্রস্থল; এতে একটি লাইব্রেরি ছিল, কুরআন পাঠ ছিল, বিবাহ, জানাজা সবই ছিল…। তারা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে, যেন তারা চায় আমরা আত্মা ছাড়া বাঁচি।’
ইসলামিক ইতিহাস গবেষক মোহাম্মদ জুহা বলেন, গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের ধর্মীয় স্মৃতি এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর ইচ্ছাকৃত আক্রমণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘মিনারগুলো ছিল শহরের ল্যান্ডমার্ক, আর এখন মানুষের স্মৃতিতে কেবল এগুলোর নাম রয়ে গেছে।’
এত কিছুর পরেও গাজা থেকে আজানের শব্দ কখনো মুছে যায়নি। বিধ্বস্ত এলাকায় যুবকরা ছাদের ধ্বংসাবশেষে উঠে ছোট ব্যাটারিচালিত লাউডস্পিকারের মাধ্যমে আজান দিচ্ছে। সন্ধ্যায় লোকেরা ভাঙা দেয়ালের কোণে পুরানো মাদুর বিছিয়ে প্রার্থনা করছে।